দৈনিক বাংলার রবি:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রত্নতাত্ত্বিকরা দিনের পর দিন ব্যয় করছেন পৃথিবীর বিভিন্ন রহস্যভেদ করতে। তাদের একেকটি গবেষণায় সময় লাগে মাসের পর মাস। আবার কিছু গবেষণা রহস্য হয়েই রয়ে যায়। তেমনই এক রহস্যের জন্ম, দিয়েছে মাত্র পাঁচ ইঞ্চি লম্বা এক মানব কঙ্কালের।
ভাবছেন হয়তো কোনো মানব ভ্রুন হবে হয় তো! তাহলে তো গবেষকদের মাথা ব্যথাই ছিল না। সহজেই হয়ে যেত এর সমাধান। তবে জানা যায়, কঙ্কালটির খুলি শঙ্কুর মত লম্বা, চোয়াল দুটো সামনে এগিয়ে এসেছে। চোখের কোটর দুটির আকৃতি অস্বাভাবিক। বলা যায়, একেবারে প্রাপ্ত বয়স্ক একটি মানুষের কঙ্কাল।
২০০৩ সালে উত্তর চিলির আটাকামা মরুভূমির মধ্যে পরিত্যক্ত ও ভুতুড়ে শহর লা নোরিয়ায় পাওয়া যায় কঙ্কালটি। পরিত্যক্ত হলেও বর্তমানে অনুমতি নিয়ে পর্যটকেরা সেখানে ঘুরতে যান। সেদিন পর্যটকদের সঙ্গে গাইড হিসেবে লা নোরিয়াতে গিয়েছিলেন ব্যবসায়ী অস্কার মুনোজ। শহরটির পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর ভিতরে ঘোরাফেরার সময়, ধুলোর ভেতর পরে থাকা ছোট্ট একটি চামড়ার ব্যাগ দেখতে পান।
হাতে নিয়ে বুঝতে পারেন ভেতরে শক্ত কিছু আছে। ব্যাগের ভেতর কাপড়ে মোড়া কিছু একটা জিনিস। কাপড়ের আবরণ সরাতেই চমকে উঠেছিলেন মুনোজ। ব্যাগটির ভেতর শুয়ে ছিল মাত্র পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি কঙ্কাল। এত ছোট ও এত ভয়ঙ্কর কঙ্কাল মুনোজ এর আগে দেখেননি। বেশ ভয়ে পেয়ে গিয়েছিলেন মুনোজসহ তার সঙ্গে থাকা পর্যটকরা।
কঙ্কালটির খুলি শঙ্কুর মত লম্বা, চোয়ালদুটো সামনে এগিয়ে এসেছে। চোখের কোটর দুটির আকৃতি অস্বাভাবিক। শিরদাঁড়াটি বাঁকা। কঙ্কালটি অতি ক্ষুদ্র হলেও, নিঁখুত অবস্থায় সংরক্ষিত ছিল আটাকামা মরুভূমির শুষ্ক পরিবেশে। কঙ্কালটির প্রতিটি অংশ আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছিল। কঙ্কালটির গায়ে তখনো লেগেছিল শুকিয়ে যাওয়া কিছু মাংসপেশী।
ছোট্ট একটি কঙ্কাল
কল্পবিজ্ঞানের সিনেমা দেখা মুনোজ, কঙ্কালটির মাথার আকৃতি থেকে ধরে নিয়েছিলেন এটি ভিনগ্রহের জীব বা এলিয়েনের কঙ্কাল। এলিয়েনের কঙ্কাল ভেবে বেচে দেয় সে। বেশ চড়া দামেই চোরাচালান এক দলের কাছে বিক্রি করে সে কঙ্কালটি। এভাবেই বিভিন্ন হাত ঘুরে কঙ্কালটি চিলি থেকে চলে আসে স্পেনে। ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের বিষয়ে আগ্রহী বার্সিলোনার ব্যবসায়ী র্যামন নাভিয়া-অসোরিও, উচ্চমূল্যে কিনে নেন কঙ্কালটিকে।
ক্ষুদ্র এই কঙ্কালটির খবর ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বেই। সেভাবেই এর খবর পান আমেরিকার ভার্জিনিয়ার ড. স্টিভেন গ্রিরের কাছে। ড. গ্রির ছিলেন ‘দ্য ডিসক্লোজার প্রজেক্ট’ নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। যে সংস্থাটির কাজ হল ভিনগ্রহবাসীদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা। ড. গ্রির যোগাযোগ করেছিলেন আটার মালিক অসোরিওর সঙ্গে। কঙ্কালটির ডিএনএ পরীক্ষা করার অনুমতি চেয়েছিলেন।
২০১২ সালে ড. স্টিভেন গ্রিরকে কঙ্কালটির এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিলেন অসোরিও।পরের বছরেই মুক্তি পেয়েছিল ড. স্টিভেন গ্রিরের গবেষণা নিয়ে তৈরি বিখ্যাত ও বিতর্কিত তথ্যচিত্র ‘সিরিয়াস’। সেই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে পুরো পৃথিবী জানতে পারে আটাকামা স্কেলিটনের কথা। তথ্যচিত্রের একটি লাইন উই আর নট অ্যালোন। উল্কাগতিতে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর অর্থ, মহাবিশ্বে আমরা একা নই। এই মহাবিশ্বেই ছড়িয়ে আছে আটারা। শুধু আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না।
গত ১০০ বছর ধরে ভিনগ্রহবাসীদের নিয়ে পৃথিবীবাসীদের কৌতূহল ও উন্মাদনা এমনিতেই চুড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ, এই ভিনগ্রহবাসীদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। তবে রহস্যময় ওই কঙ্কালটি ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, প্রমাণ করেন বিজ্ঞানী গ্যারি নোলান। রহস্যময় কঙ্কালটির ডিএনএ পরীক্ষার পর জানা যায় কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। গবেষণা সংক্রান্ত প্রাথমিক একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত সায়েন্স ম্যাগাজিনে। পরে ২০১৮ সালে, সেটি বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছিল জিনোম রিসার্চ ম্যাগাজিনে।
রহস্যময় ক্ষুদ্র মানব কঙ্কাল
মানব স্ত্রী ভ্রুণের কঙ্কাল বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। ভ্রুণটি হয় মায়ের পেটে, নয়তো সময়ের আগে জন্ম নিয়ে, কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গিয়েছিল। আগে অনুমান করা হয়েছিল প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা কঙ্কালটির বয়স দুই হাজার বছর, আর এটি প্রাপ্ত বয়স্ক। তবে না এটি ছিল একটি শিশু কন্যার ভ্রূণ।
গবেষকদের মতে, কঙ্কালটি ৪০ থেকে ৫০ বছরের পুরনো। কঙ্কালটির ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’ পরীক্ষা করে জানা যায়, এটি চিলিরই সন্তান। তবে তার ডিএনএ-এর মধ্যে ইউরোপীয়ান পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য আছে। গবেষকেরা কঙ্কালটির ৬৪ টি জিনের মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন।
অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল এমন সাতটি জিনে, যেগুলো মানুষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ভ্রুণটির খুলি, মেরুদণ্ড, কোলাজেন, অস্থিসন্ধি, পাঁজর ও ধমনীতে অস্বাভাবিক বিকৃতি ছিল। ১২টির জায়গায় ১০টি পাঁজর ছিল। বামন হয়েই জন্ম নিতে চলেছিল ভ্রুণটি। জিনের অস্বাভাবিকতা ছাড়াও একটি বিরল জিনগত রোগ ছিল কঙ্কালটির।
বিজ্ঞানীদের মতে, মাত্র ১৫ সপ্তাহের ভ্রুণ হলেও, তার হাড় ছিল ছয় বছরের শিশুর মতো শক্তপোক্ত। বিজ্ঞানীদের রায়, কঙ্কালটির গঠনগত বিকৃতির পিছনে আছে জিনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন। কঙ্কালটি কামা মরুভূমির পরিবেশ হয়ত জিনগুলোর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী।
যদিও এই কঙ্কালের জিন বলছে সে চিলির আদি বাসিন্দা। তবে তেমন জিনগত অস্বাভাবিকতা, চিলির কোনো না কোনো মানুষের ভ্রুণের মধ্যে পাওয়া উচিত ছিল। এখনো পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। এটি বড়ই এক রহস্য। অন্যদিকে, এলিয়েন বিশ্বাসীরা বরচেন, মানুষের ১৫ সপ্তাহের স্বাভাবিক ভ্রুণের কঙ্কালের সঙ্গে সেটির মিলগুলো অসম্ভব প্রকৃতির। এত প্রশ্ন নিয়েও এখনো চলছে আটা নামক কঙ্কালটিকে নিয়ে গবেষণা।
Leave a Reply